An enjoyable weekend trip in Bishnupur
দীর্ঘদিন তো লকডাউন কাটালেন। কোভিড-১৯ ভীতি কাটিয়ে, উইকএন্ড এলেই মন উরু উরু? হাতে অল্প ছুটি? সাধ ও সাধ্যের মধ্যে বেড়ানোর জন্য অল্পচেনা গন্তব্য খুঁজছেন? একে ওকে ফোন অথবা নেট ঘেঁটে ঘ? তাই ঘুরে ফিরে সেই, দীপুদা? মানে, দীঘা-পুরী-দার্জিলিং? তাহলে যাবেন কোথায়? কে দেবে তার সন্ধান?
সন্ধান দেবে দেখো বাংলা , বাংলার মনের আয়না
সোনার বাংলার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা ঐতিহ্যের সন্ধান দেবে,, দেখো বাংলা। কলকাতা থেকে গাড়িতে দেখে নেব, চেনা বাংলার অল্পচেনা রূপ।
৩ দিন ৪ রাতে দেখো বাংলা মল্লভূম
সুজলা সুফলা বাংলার রুক্ষতায় জড়িয়ে রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য।একদিকে যামিনী রায়, অন্যদিকে রামকিঙ্কর বেইজের জন্মেছেন এই মাটিতে। রাঢ় বাংলার স্থাপত্য, ভাস্কর্য, টেরাকোটার মন্দির আর মল্লরাজাদের বৈভবের মল্লভূম দেখে নেব।
১ম দিন :- কলকাতা থেকে ভোরে গাড়ীতে চেপে বসুন,পথে শক্তিগড়ে ব্রেকফাস্ট। খড়গপুর হয়ে চলে আসব গড়বেতা। দেখে নেব বাংলা ব্র্যান্ড, ক্যানিয়ন গ্রান্ড, গনগনি। লালমাটি আর কাজুর জঙ্গল পেরিয়ে দেখে নেব দূরে শিলাবতী নদী আর অদ্ভুত ভূপ্রকৃতির ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথর কিভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নানান আকার ধারণ করে গনগনে আগুনের রঙ ধরেছে। এখানেই লাঞ্চ সেরে নিন। এখানকার অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখে ফিরে আসব, বিষ্ণুপুর। এখানেই রাত্রিবাস। ডিনার।
২য় দিন :- ব্রেকফাস্ট সেরে আজ দেখে নেব, বিষ্ণুপুরের নানান মন্দির। একদা মল্লরাজাদের রাজধানী। মন্দির নগরী বললেও ভুল হবে না। রাসমঞ্চে। এই মঞ্চের চূড়ো ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে, পিরামিডের আকারে। ১৬০৭ সালে রাজা মল্লরাজবীর হাম্বির ৩৫ ফুট উঁচু ও ৮০ ফুট চওড়া এই অনবদ্য রাসমঞ্চের নির্মাণ করেন। এখানেই অনুষ্ঠিত হত, রাস উৎসব। এরপর দেখে নেওয়া যায়, দলমাদল কামানটি। রাসমঞ্চের দক্ষিণে, ২৯৬ মন ওজনের মাকড়া পাথর গলানো লোহা দিয়ে তৈরী কামান টিতে এতবছর পরেও এতটুকু মরচে পড়েনি। বর্গি হামলার সময়, মল্লরাজাদের কুল দেবতা স্বয়ং মদনমোহনের নির্দেশে কামান থেকে গোলা বর্ষণ হতো। দলমাদল কামানের থেকে অল্পদূরে ছিন্নমস্তা মন্দিরে লালপাথরে দেবী ছিন্নমস্তার মূর্তি দেখে লালজি, মুরলীমোহন, রাধাগোবিন্দ, শ্রীধর, কেষ্টরাই, রাধামাধব, নন্দলাল, সর্বমঙ্গলা ,শ্যামরাই, রাধেশ্যাম মন্দির দেখে নিন। লাঞ্চ সেরে নেব।
এবার বিষ্ণুপুরের একমাত্র শিবমন্দির, মল্লেশ্বর মন্দির দেখে চলে আসুন, জোড়বাংলায়। ১৬৫৫ সালে তৈরী দোচালা কুটীরের এক আশ্চর্য সংযুক্তির মধ্যস্থলে একটি চারচালা শিখরবিদ্যমান, তাই মন্দিরের নাম জোড়বাংলা। মন্দিরের গায়ে মহাভারতের নানান ঘটনা, শিকার দৃশ্যের পোড়ামাটির অলংকরণ অসাধারণ। লালবাঁধ, বড়পাথর দরজা, যোগেশচন্দ্র পুরা কীর্তি সংগ্রহালয়। এখানকার বালুচরি, স্বর্ণচরীশাড়ির কদর জগৎ বিখ্যাত। কেনাকাটিও সেরে নিতে পারেন।
৩য় দিন :- ব্রেকফাস্ট সেরে ৩২ কিমি দূরের পাঁচমুড়ার হস্তশিল্পের গ্রাম। বাঁকুড়ার সেই বিখ্যাত বড় বড় ঘোড়াসহ নানান পোড়ামাটির খেলনা বা ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরি করেন এই গ্রাম। গ্রামে ঢুকলেই দেখা যাবে, পুরুষ- মহিলারা আপন মনে মাটির নানান আকারের ঘোড়া হাতির গায়ে নানান আঁকিবুঁকি আঁকছেন। ধড় ও মুন্ড আলাদা করা। তারপর আগুনে পুড়িয়ে তাকে পালিস করে বাজারজাত করা হয়। ইচ্ছে হলে কেনাকাটিও সেরে নিতে পারবেন। প্রায় ৮৬ বর্গ কিমি বিস্তৃত আকাশমণি আর ইউক্যালিপটাসের ছায়ামাখা অনবদ্য, মুকুটমণিপুর। বিশাল জলাধারে বাঁধা পড়েছে, কংসাবতী নদী। নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। নদীর জলে বিশাল জলাশয়ের বুকে বাঁধা আছে নৌকা। ভেসে পড়ুন অথবা পাড়ে বসে অসাধারণ নৈসর্গিক শোভা উপভোগ করুন।কংসাবতি আর কুমারীর সঙ্গমস্থল। লাঞ্চ সেরে সারাদিন মুকুটমনিপুরের অফুরান সৌন্দর্যকে উপভোগ করুন। দেখে নিন, অসাধারণ সূর্যাস্ত।মুকুটমনিপুরে রাত্রিবাস ও ডিনার।
৪র্থ দিন :- ব্রেকফাস্ট সেরে এবার মুকুটমনিপুর থেকে নৌকায় চেপে দেখে নিন,দ্বীপের মাঝের বনপুকুরিয়াকে। এবার কলকাতায় ফেরার পালা। পথে লাঞ্চ।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:-
গনগণি :- আঁকাবাঁকা বয়ে চলা এক নদী। নদীর পাড়ে খোয়াই। ঘন সবুজের মাঝে বিশাল গর্জ। মাঝে মাঝে নদীর জল ঢুকে পড়ে খোয়াই এর গর্জে। লাল ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথর বাতাস আর জলের স্পর্শে এসে অদ্ভুত আকার ধারণ করে। আর সৃষ্টি হয় নানান প্রাকৃতিক কারুকাজ। কোথাও খিলান, স্তম্ভ। আবার কোথাও পিরামিডের আকার ধারণ করেছে। প্রকৃতির এই অপরূপ রুপ দেখতে হলে অবশ্যই চলে আসুন,পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার এই অল্পচেনা গনগনিতে।
গড়বেতা স্টেশন থেকে মাত্র ২ কিমি চলে আসুন। গড়বেতা কলেজের উল্টোদিকের লালমাটির খোয়াই ধরে আসলেই জড়িয়ে ধরবে সবুজ কাজুর জঙ্গল। সেই আঁকাবাঁকা লাল মোরামের পথ থমকে দাঁড়িয়েছে এক অপরূপ ভূপ্রকৃতির সামনে। ডাইনে-বামে সবুজের ঢেউের মাঝে লাল-হলুদ-সবুজের অনবদ্য কম্বিনেশন। লাল-হলুদ মাকড়া পাথর নানান আকার নিয়েছে। স্তম্ভ, খিলান, মিশরীয় ফারাওদের মুখমন্ডল। আর মাটির নানান স্তরে স্তরে খাঁজ। সেই খাঁজের ফাঁকে রঙের বাহার। লাল-হলুদে এসে মিশেছে গাঢ় সবুজের আস্ফালন। প্রকৃতির অনবদ্য এই শিল্পকর্মের রুপ মনে করিয়ে দেয়, আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কথা। ইচ্ছে হলেই, ভেসে পরুন শিলাবতীর জলে।
ইতিহাস যেন ফিসফাস করে ওঠে। চুয়াড় বিদ্রোহের ভূমিজ নেতা, সর্দার অচল সিং এখান থেকেই তার লড়াই চালিয়ে গেছেন, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে| ইতিহাসে এই বিদ্রোহকে বগড়ির লায়েক বিদ্রোহ বা পাইক বিদ্রোহ নামেও পরিচিত। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর সর্দার অচল সিং ধরা পড়ে যান। তারপর সর্দার অচল সিং কে গনগনির এই খোয়াইতে ফাঁসি দেন ইংরেজরা। গনগনি ঢোকার ঠিক ডানদিকেই সর্দার অচল সিং নামাঙ্কিত স্টেডিয়াম।
পুরাণের মিথ বলছে, মহাভারতের বকদ্বীপ ছিল এই গড়বেতা। আর এই বকদ্বীপেই ছিল বকরাক্ষসের রাজপাট। এখানে তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ সমস্ত অধিবাসীরা। বকদ্বীপ থেকে প্রতিদিন একজন করে মানুষ তার কাছে ভেট হিসেবে পাঠাতে হত। পঞ্চপান্ডব হাজির হন। যুধিষ্টির দেখেন, এক বৃদ্ধ নদীর পাড়ে বসে হাপুস নয়নে বসে কাঁদছেন। কারণ, জিজ্ঞাসা করতেই জানলেন। বকরাক্ষসের অত্যাচারের কাহিনী। প্রতিদিন গ্রামের একজন তার খাদ্য হিসেবে ভেট পাঠাতে হয়। এবার তাদের পরিবারের পালা। আর তার পরিবারে তিনিই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কাল যদি তাকে বকাসুরের খাদ্য হিসেবে যেতে হয়, তাহলে তার পরিবার না খেতে পেয়ে মারা যাবে। যুধিষ্ঠির বৃদ্ধকে নিশ্চিন্তে বাড়ি যেতে বলেন। গোটা ঘটনাটা বর্ণনা করেন, তার ভাইয়েদের কাছে। সবকিছু, শুনে মধ্যম পাণ্ডব ভীম, ভীষণ চটে গেলেন। ভীম বললেন, আমি যাব। পরদিন, ভীম এসে হাজির নদীর পাড়ে। বকরাক্ষস বেজায় খুশি, ওইরকম হৃষ্টপুষ্ঠ খাদ্য পেয়ে। এরপর ভুল ভাঙে। মধ্যম পান্ডব আর বকরাক্ষসের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের ফলে জমিতে নানান জায়গায় বসে যায়, তার ফলেই আজকের এই গনগনি।
দূরে ছবি আঁকা শিলাবতির পাড়ে রেলসেতু দিয়ে বিকেলের লোকাল চলে গেল। আকাশের পশ্চিমপাড়ে তখন শুধুই মেঘের আড়ালে অস্তগামী সূর্যের শোভায় গনগনির ক্যানভাসে সন্ধ্যে নামতে থাকে। অস্তরাগের সেই আকাশ আর গনগনি এক অসাধারণ যুগলবন্দী।
এখানে থেকে দেখে নিতে পারেন, গড়বেতার সর্বমঙ্গলার মন্দির।